শিশু দত্তক নিতে চাইলে করণীয় কি।

শিশু দত্তক নেয়ার আগে সচেতন থাকুন। 

শিশু দত্তক নিতে চাইলে কী কী নিয়ম পালন করতে হয় ?

Date-17-08-2021.

শিশু দত্তক নেয়ার সময় সচেতনতা। Awareness during child adoption শিশু দত্তক নিতে চাইলে কী কী নিয়ম পালন করতে হয় ?


Child Adoption. অনেক নিঃসন্তান দম্পতি কিংবা যাদের বিবাহের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর অনেক চেষ্টা করেও সন্তান হয় না তারা মানসিকভাবে অনেকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পরেন এবং নিজেকে নিজে অসহায় মনে করেন। এই অসহায়ত্ব গোছাতে অনেক নিঃসন্তান দম্পতি শিশু দত্তক নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। 

আবার অনেক নিঃসন্তান দম্পতি সন্তান লাভের চেষ্টায় বিভিন্ন গাইনী ডাক্তারের চিকিৎসা গ্রহণ করেন। চিকিৎসাকালীন বা চিকিৎসার সুবাদে বিভিন্ন হাসপাতালে আসা যাওয়ার সুবাদে কতিপয় অসাধু ব্যক্তির সাথে পরিচয় ঘটে। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে নিঃসন্তান দম্পতি সরল বিশ্বাসে অসাধু ব্যক্তির প্রলোভনে শিশু দত্তক পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করে থাকেন। 

কিন্তু সন্তান দত্তক নেয়ার বৈধ বা আইনগত পদ্ধতি কি তা না জানায় অসাধু ব্যক্তির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকার বিনিময়ে সরল বিশ্বাসে অনেক নিঃসন্তান দম্পতি শিশু চোর চক্র কর্তৃক চুরি করা শিশুকে দত্তক নিয়ে থাকেন। না জেনে অসাধু ব্যক্তি কর্তৃক চুরি করা শিশু দত্তক নেয়ার কিছুদিন বা কয়েক মাস যেতে না যেতেই আইনী জঠিলতায় সেই নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক নেয়া শিশুকে পুনরায় প্রকৃত মাতা-পিতার নিকট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

কিভাবে শিশু দত্তক নিলে প্রতারিত হবেন না এবং বৈধভাবে কিভাবে শিশু দত্তক নিতে পারবেন সেই বিষয়ে এই পোস্টে কিছু তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি নিজ শিশু সন্তানকে কিভাবে শিশু চোর চক্রের থেকে নিরাপদ রাখবেন সেই বিষয়েও আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। আশাকরি পোস্টটি পরে উপকৃত হবেন।   

তার আগে একটি বাস্তব ঘটনার বর্ণনা দিই-

জনৈক এক মহিলার স্বামী ৫/৬ মাস পূর্বে সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করে। ঐ মহিলার এক মেয়ে ও এক ছেলে আছে। বড় মেয়ের বয়স ০৭ বছর ও ছোট ছেলের বয়স মাত্র ০৬ মাস। তিনি তার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে কোন কাজ কর্ম করতে না পারায় অভাবের তারনায় প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকায় ভিক্ষা করত। 

তারই ধারাবাহিকতায় তিনি একদিন জনবহুল রাস্তার ফুটপাতে বসে ০৬ মাসের দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা করার সময় অজ্ঞাতনামা ০২ জন লোক তার কাছে আসে এবং বিভিন্ন কথাবার্তা ও কুষলাদি বিনিময়ের পর তাকে খাবারের একটি বোতলজাত জুস খেতে দেয়। তিনি উক্ত জুস পান করার সাথে সাথে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। 

পরবর্তীতে মহিলাটির জ্ঞান ফেরার পর দেখেন যে, তিনি একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছেন। তার শিশু সন্তানটি তার কাছে নেই। তখন তিনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে তার হাসপাতালে আসার কারণ ও সন্তানের বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে জানান যে, তিনি অজ্ঞান ছিলেন। ০২ জন লোক তাহাকে অজ্ঞান অবস্থায় চিকিৎসার জন্য উক্ত হাসপাতালে নিয়ে আসে। সাথে অনুমান ৫/৬ মাস বয়সের একটি শিশু সন্তানও ছিল। 

মহিলার চিকিৎসা চলাকালীন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদ্বয় ঔষধ আনার নাম করে উক্ত শিশু সন্তানকে নিয়ে হাসপাতালের বাহিরে যায় কিন্তু আর ফিরে আসে নাই।  

মহিলার ধারণা অজ্ঞাতনামা ঐ ০২ জন ব্যক্তি যাহারা তাহাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়া আসছে তারা ঐ মহিলার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে কৌশলে অপহরণ করেছে। ঐ মহিলার চিকিৎসা শেষে সুস্থ্য হওয়ার পর নিকটস্থ থানায় গিয়ে ঘটনার বিস্তারিত জানানোর পর এই ঘটনায় থানায় একটি নিয়মিত মামলা রুজু করা হয়। 

মামলা রুজু হওয়ার প্রায় ৫/৬ মাস পর আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় মামলা তদন্তকারী পুলিশ অফিসার ০২ জন শিশু অপহরণকারীকে সনাক্ত ও আটক করেন। আটককৃত ব্যক্তিদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যে, তারা শিশুটিকে অপহরণ করে এক মহিলার নিকট রাখে। 

পরবর্তীতে অপর এক মহিলার মাধ্যমে শিশুটিকে এক নিঃসন্তান দম্পতীর নিকট বিক্রয় করে দেয়। শিশুটিকে বিক্রয়ের সময় ঘটনায় জড়িতরা শিশুটির মাতা-পিতা ও নিকট আত্মীয় পরিচয় দেয় এবং টাকার অভাবে শিশুটিকে বিক্রয় করছে বলে নিঃসন্তান দম্পতিকে জানায়। নিঃসন্তান দম্পতি তাদের কথায় সরল বিশ্বাসে শিশুটিকে নিজ সন্তানের মত লালন পালন করার জন্য দত্তক নেয়। শিশুটিকে বিক্রয়ের পর বিক্রয়ের টাকা জড়িত চার জন ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়। 

জড়িতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্তকারী পুলিশ অফিসার নিঃসন্তান দম্পতির ঠিকানায় গিয়ে তাদের ঘটনার বিস্তারিত জানায় এবং নিঃসন্তান দম্পতির হেফাজত হতে অপহৃত শিশুটিকে উদ্ধার করে। শিশুটিকে উদ্ধার করার পর শিশুটিকে তার প্রকৃত মায়ের নিকট শিশুটিকে বুঝিয়ে দেয়। শিশুটিকে তার প্রকৃত মাতার নিকট বুঝিয়ে দেয়ার সময় থানায় এক হৃদয় বিদারক পরিবেশ সৃষ্টি হয়। 

কারণ একজন প্রকৃত মা তার হারিয়ে যাওয়া শিশুটিকে দীর্ঘদিন পর ফিরে পাওয়ার আনন্দে আত্মহারা হয়ে গগণ বিধারী ক্রন্দন করছে, আর অন্যদিকে দত্তক নেয়া মাতা যিনি আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে ঐসন্তানকে নিজের সন্তান বলে পরিচয় দিয়েছেন এবং নিজ সন্তানের মত লালন পালন করেছেন সেই সন্তানকে হারানোর শোকে গগণ বিধারী ক্রন্দন করছে। যাইহোক আইনের কাছে আবেগ চলে না। তাই অনিচ্ছা স্বত্বেও কয়েক মাসের জন্য দত্তক নেয়া শিশুটিকে তার প্রকৃত মায়ের নিকট ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হল।  


কিছু সাধারণ সচেতনতা-

১) শিশু দত্তক নেওয়ার আগে শিশুর পিতা-মাতা সম্পর্কে সঠিকভাবে যাচাই বাচাই করুন। প্রয়োজনে জাতীয় পরিচয়পত্র/ এনআইডি কার্ড যাচাই করুন। যারা শিশু দত্তক দিতে আগ্রহী তারা ঐ সন্তানের প্রকৃত পিতা-মাতা কিনা বা বৈধ পিতা-মাতা কিনা জেনে নিন। সবাই  বিষয়টি গোপন রাখতে চায়। গোপনীয়তা বজায় রাখুন কিন্তু আইগত দিক মাথায় রাখুন। 

২) নবজাতক শিশু সন্তান নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় সেই হাসপাতালে আপনার আসপাশে থাকা কতিপয় অপরিচিত ও অসাধু ব্যক্তি সম্পর্কে সতর্ক থাকুন।

৩) অপরিচিত কেউ ঘনিষ্টতা জমিয়ে কিছু খেতে দিলে তা কখনোই খাবেন না। 

৪) সর্বোপরি চোখ-কান খোলা রেখে চলুন।

৫) এই ধরণের অসাধু কোন ব্যক্তির সন্ধান পেলে নিকটস্থ থানা-পুলিশকে অবহিত করুন। 

৬) বিশেষ প্রয়োজনে জাতীয় জরুরী সেবা-৯৯৯ এ কল করুন।


শিশু দত্তক নেয়ার কিছু পূর্ব শর্ত সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো-

১। যারা নিঃসন্তান দম্পত্তি কিংবা সন্তান জন্মদানে অক্ষম তারা চাইলে শিশু দত্তক নিতে পারে। তবে যারা শিশু দত্তক নিতে আগ্রহী তাদের শিশুটিকে লালন পালন করার সক্ষমতা থাকতে হবে এবং শিশুটিকে নিজের সন্তান হিসাবে লালন পালন করার মানসিকতা থাকতে হবে।

২। যেসব বিবাহিত মহিলার স্বামী ও সন্তান নেই এবং পুনরায় বিবাহ করার কোন ইচ্ছা নাই এবং সন্তান পালনের মত আর্থিক সক্ষমতা আছে এমন বিবাহিত মহিলাও চাইলে শিশু দত্তক নিতে পারেন। 

৩। অনেক অবিবাহিত মহিলা আছেন যারা বিয়ে করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন কিংবা নিজের বিয়ের বয়স নেই বলে মনে করছেন তারাও চাইলে সন্তান দত্তক নিতে পারেন। তবে সন্তান পালনের মত মানসিকতা ও আর্থিক স্বচ্চলতা থাকতে হবে। 

৪। পালক সন্তান দত্তক নেয়া দম্পতির সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয় না। কিন্তু সন্তান দত্তক নিলে তার কিছু মৌলিক অধিকার পালনের দায়িত্ব নিতে হবে। যেমন শিশুটির শারীরিক মানসিক যত্ন নিতে হবে। অসুস্থ হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষা ও খাবার সহ যথাযোগ্য ভরণ পোষনের দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিশুটির সামাজিক নিরাপত্তা, স্নেহ-ভালবাসা দিতে হবে। সর্বোপরি শিশুটিকে নিজের ঔরসজাত সন্তানের ন্যায় লালন পালন করতে হবে। 

৫। যারা শিশু দত্তক নিতে আগ্রহী তাদের বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। তবে ৩৫-৪০ বছর হলে ভাল হয়। 


দত্তক সন্তানের বৈধ অভিভাকত্ব লাভের উপায় কি-

১. শিশু দত্তক নেয়ার আগে পারিবারিক আদালতে শিশুকে দত্তক নেয়ার আবেদন করতে হবে।

২. শিশুর প্রকৃত অভিভাবক হতে দত্তক দেওয়ার বিষয়ে অনাপত্তি পত্র গ্রহণ করতে হবে। 

৩. আদালতের আদেশ প্রাপ্তির পর দত্তক নেয়া দম্পতি শিশুটির বৈধ অভিভাবক বলে গণ্য হবে।

কারো মুখের কথায় সরল বিশ্বাসে গোপনে দত্তক নেয়া থেকে বিরত থাকুন। দত্তক দেয়া পিতা-মাতার প্রকৃত পরিচয় জেনে তাড়াহুড়ো না করে দত্তক নেয়ার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন কাউকে মুখের কথায় বিশ্বাস করার কোন মানে হয় না। মুখের কথার কোন আইনগত ভিত্তি নেই। তাই এইসব বিষয়ে দালিলিক ডকুমেন্ট রাখার চেষ্টা করুন।

প্রসবকালীন সময়ে অনাগত সন্তানের পিতা ও পরিবারকে যেসব বিষয়ে বাড়তি নিরাপত্তা পালন করা প্রয়োজন ?

বিভিন্ন মাতৃসদন হাসপাতালে নবজাতক শিশু চুরির খবর মাঝেমধ্যে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তাই প্রসবকালীন সময়ে প্রত্যেক নবজাতকের পিতা বা পরিবারের উচিৎ প্রসবকালীন সময়ে প্রসূতি মা ও নবজাতক সন্তানের দায়িত্ব নেয়া এবং প্রসবকালীন সময়ে বাড়তি নিরাপত্তা বজায় রাখা। 

কারণ বর্তমান সময়ে প্রায় সকল প্রসূতিকে বিভিন্ন মাতৃসদন হাসপাতালে ডেলিভারীর জন্য ভর্তি করানো হয়। সেই জন্য শিশু চোর চক্র বিভিন্ন কৌশলে মাতৃসদন হাসপাতালের ভিতরে ও বাইরে অবস্থান করে। সুযোগ বুঝে কৌশলে নবজাতক শিশু চুরি করে নিয়ে যায়। 

তাই প্রসবকালীন সময়ে নবজাতক সন্তানের পিতা ও পরিবারকে বাড়তি সচেতনতা ও নিরাপত্তা অবশ্যই পালন করতে হবে। প্রসবকালীন সময়ের পর যতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে ততদিন নবজাতক সন্তানের পিতা সহ পরিবারের লোকজন বা নিকট আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে রুটিন করে নবজাতক সন্তানের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। 

আবার অনেক সময় কোথাও বেড়াতে যাওয়ার সময় কিংবা প্রয়োজনে কোথাও যাওয়ার সময় বাস, ট্রেন ও বিভিন্ন পাবলিক প্লেসেও এই ধরণের শিশু চুরির ঘটনা ঘটে। তাই যেখানেই হোক অপরিচিত কেউ কিছু খেতে দিলে কোন অবস্থাতেই খাওয়া উচিত নয়। বাড়ীর বাইরে অপরিচিত কেউ ঘনিষ্টতায় জড়ানোর চেষ্টা করলে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।    

সাবধান থাকুন, সতর্ক থাকুন।

#পোস্টটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন। 

ধন্যবাদ। 

Comments

Popular posts from this blog

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কি জেনে রাখুন।

মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারে সচেতনতা ও করণীয় কি।

ফেসবুক বা অনলাইনে হয়রানির শিকার হলে কি করবেন।