নতুন ভবে পুনজন্ম মানে কি।
নতুন ভবে পুনজন্ম দেশনায় ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের মহোদয়।
"যাযং তণ্হা পোনোব্ভবিকা"- তৃষ্ণা নতুন ভবের জনক।
"ভব নেত্তি"- তৃষ্ণা ভবকে বহন করে।
'ভবগামী'- তৃষ্ণার পুনজন্মের কর্মবীজ।
কর্ম ও সংসারঃ
পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মেরও কর্মের কথা বলা আছে। তবে বুদ্ধের সু-ব্যাখ্যাত কর্মের ব্যাখ্যার সাথে সারগর্ভ মিল নেই সেদিকে খেয়াল রেখে লিখছি।
অন্য কোন মতবাদের কর্মঃ
ব্রহ্মার সৃষ্ট আত্মা সংসার বিচরণ করে। দেহঘর ভেঙ্গে গেলে কর্তার ইচ্ছামতে আরেক নতুন ঘর তৈরি করে দেয়। মরে গেলে তার আত্মা অন্য আরেক দেহের প্রবেশ করে দেয়। এটি তাদের মতবাদ।
সাতি ভিক্ষুর দৃষ্টিঃ
উদয়-বিলয় অনন্ত বীথি। এটি অচিন্তনীয়। বুদ্ধের সময়ে "সাতি নামক ভিক্ষু" মিথ্যাদৃষ্টি জং ধরে আত্মার কথা বলেছিল যে আত্মা সুখ-দুঃখ অনুভব করে। এটি উপরোক্ত মতবাদের মত। চিত্ত ও রূপ কর্তার ব্যবহৃত জিনিসের মত। চিত্ত ও রূপগুলো আত্মার অধীন। "তদেব বিঞ্ঞাণং সংসরাতি" আত্মার সংসার বিচরণ করে।
কর্ম নিয়ে বুদ্ধ কি বলেছিলেন?
বুদ্ধ বলেছিলেন "বিঞ্ঞাণং পটিচ্চ সমুপ্পন্নং" চিত্ত নামক বিজ্ঞাণটি কার্যকারনে উৎপন্ন হয় (বিষয়ালম্বনের কারনে উৎপন্ন হয়)। "অনিচ্চ সম্ভতং কুতো নিচ্চং ভবিস্সতি" অনিত্যের মাঝে উৎপন্ন বিজ্ঞাণটি কিভাবে নিত্য হবে? সাতি ভিক্ষু আত্মা স্বীকার আত্মদৃষ্টিকে ছিন্ন করার কঠিন। যদি সঠিক শিক্ষা না পায়।
জাতক নিপাতে "যথাকম্মং গতো" কর্মানুসারে গতি প্রাপ্ত হয়। মিলিন্দ প্রশ্ন গ্রন্থে "ন চসো নচ অঞ্ঞো" সেও নয় অন্যও নয় এটি কার্যকারন অবিচ্ছিন্ন সন্ধিমাত্র। পুনজন্মটা পুরান থেকে নতুন হওয়া নয় তবে নতুন+পুরান সংযোগ থাকে।
মতবাদ ও অপবাদঃ
প্রাণী আত্মা বাসা বদলানোর মত। বুদ্ধও নবম অবতাররূপে মানব দেহের প্রবেশ করে পথ প্রদর্শক অবতার জন্ম নিয়েছিল। এটি বুদ্ধকে হারে হারে অপমান করল।
বুদ্ধের সু-ব্যাখ্যাত ধর্মের অণুপরমাণু সুক্ষ্ম অদৃষ্ট সম কণাও জগতে নিত্য নয়। যদি নিত্য হতো ধর্মাচরণ করার দরকার হতো না।
অন্য মতবাদের এই দেহের বাহিরেও আত্মা আছে। তাই তাদের মতে সংসারের কথা বলার খুবই সহজ। এই দেহ পুরান হয়ে গেলে কর্ম করার ব্যক্তির আত্মার নতুন আরেক একটি দেহে প্রবেশ করে।
বৌদ্ধদের পুনজন্মঃ
পুনজন্ম জিনিসটা তত্ত্বগত অত্যন্ত কঠিন। তবে চেষ্টা করলে বুঝতে সহজ। যেমন- মন্টু মরে যাবার পর পিন্টু হলে এখানে ০১ জন নাকি? নিশ্চয় না। ০২ জন নাকি? নিশ্চয় না। এখানে একও নয় ভিন্নও নয়। এটি সংসার চলমান স্রোতে এটির কারনে ওটি উৎপন্ন বীথিমাত্র। তাই প্রতিত্যসমুৎপাদে ইহা হলে উহা হয়, "ইহা না হলে উহা হয় না"।
প্রতিসন্ধি চিত্ত উৎপত্তিঃ
প্রতিসন্ধি চিত্ত উৎপন্ন তত্ত্বের গুরুত্বপূর্ণ কারন ০৩টি কারন ছাড়া অন্য কারনও আছে-
(১) "অবিজ্জানুসয পরিক্খিত্তেন"- আচ্ছন্ন আবরণের মূল কারন অবিদ্যা যা বিষয়ালম্বনকে সঠিকভাবে জানতে দেয় না ঢেকে রাখে।
(২) "তণ্হানুসয পরিক্খিত্তেন"- দুঃখ উৎপাদনের মূল কারন তৃষ্ণা। আর দুঃখ হল পঞ্চস্কন্ধ।
(৩) "সঙ্খারানুসয পরিক্খিত্তেন" কর্ম নামক সংস্কারধর্ম নতুন আরেক জন্ম উৎপন্নকে বেগবান করে দেয়। পুরোপুরি বিচান করে দেখলে অবিদ্যা ঢেকে রাখে যাতে করে যথাসত্য কর্মকে জানতে না পারে।
লোভ তীব্রতা কারনের কর্ম করে ফেলে। মরণের মুহুর্তে তার মনের ভেতরে কর্মগুলো নতুনভাবে জেগে উঠতে থাকে। সে জীবনে যতকর্ম করেছিল বিপাক প্রদানের সুযোগ হলে সবচেয় শক্তিশালী কর্মের আলম্বনটি প্রথমে এসে মনোদ্বরে এসে উপস্থিত হবে।
ভব পারাপারঃ
ইহকালের কর্মজরূপ উৎপন্ন থেমে গিলে অতীতের কৃত কর্মের বিপাক কর্মেরযুক্ত চৈতসিকের প্রভাবে পরপারে পুনজন্ম গ্রহণ করে।
চিত্ত কিভাবে আলম্বন গ্রহণ করে দেখা যাক-
আলম্বন ৩-রকমঃ
১। ইহকালের প্রতিসন্ধি চিত্ত এর আলম্বন।
২। ভবঙ্গ চিত্ত এর আলম্বন।
৩। চ্যুতিচিত্ত এর আলম্বন। বিশেষ কোন আলম্বন না থাকলে ইহজন্মের প্রতিসন্ধি কালে বিজ্ঞাণচিত্তের আলম্বনটিকে গ্রহণ করে।
কর্ম কর্মনিমিত্তঃ
মরণাসন একজন মানুষের চ্যুতি চিত্তটি নিম্নরূপে হয়। যেমন- ভাবনা অনুশীলন করার কর্ম থেকে থাকলে পরবর্তী জন্মের প্রতিসন্ধি হয় তার কৃত কর্মের সৌমনস্য (আনন্দ) সহগত জ্ঞান সম্প্রযুক্ত মহাবিপাক চিত্ত। কৃত কর্মের শক্তিশালী আলম্বনটি প্রথমে এসে উপস্থিত হয়। ইহা কর্ম বা চেতনার জবনচিত্ত এর বিপাক প্রদান।
কর্মনিমিত্ত আলম্বন গ্রহণঃ
ভাবনা অনুশীলনকর্ম করার কালের নৈকট্যে কোন একটি অবস্থাকে চ্যুতি চিত্তটি আলম্বন গ্রহণ করে নতুন জন্মের পার হয়।
গতি নিমিত্তঃ
পরবর্তী যেখানে জন্ম হবে সেই অবস্থার আলম্বনকে গতি নিমিত্ত গ্রহণ করে চ্যুতি চিত্ত উৎপন্ন হয়ে মরতে পারে। যেমন- যে বৃক্ষ দেবতা হবে সে গাছ, পাহার পর্বত দেখবে। আর যে মানব কুলে জন্ম হবে সে মাতৃগর্ভকে দেখবে।
সন্ধির বীজ পরাঃ
উক্ত যে কোন একটি নিমিত্ত উৎপন্ন হয়ে প্রতিসন্ধির বীজ পরে। অবিদ্যার স্বভাবে "সভাব পটিচ্ছাদন লক্খণা" অবিদ্যা পুরোপুরি যথাসত্যকে ঢেকে রাখে তবে সবগুলোকে নয়। অবিদ্যা অসার অনর্থকর নিমিত্ত দেখায়। তৃষ্ণার বন্ধন আলম্বনের ডুবে থাকলে সেইক্ষণে কর্মের বীজ পরে। সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে "কম্মং খেত্তং বিঞ্ঞাণং বীজং"- বিজ্ঞাণ (প্রতিসন্ধি চিত্ত), অভিসংস্কার বিজ্ঞাণ। এই বিজ্ঞাণচিত্ত নতুন একটি জন্ম গ্রহণের মরণাসন্ন জবনের সাথে যুক্ত হয়ে উৎপন্ন হয়।
সন্ধির বীজ বপনঃ
কর্ম- জমিনের মত।
তৃষ্ণা- কৃষকের মত (নন্দিরাগ সহগত তত্র তত্রাভিনন্দিনী)
বিজ্ঞাণ- বীজের মত।
'কর্ম' কে এরিয়ে চলার উপায় নাই। অবিদ্যার আচ্ছন্ন না হলে, তৃষ্ণার আসক্তি না থাকলে কর্মের বিপাক পরবর্তী জন্ম প্রদানের অক্ষম। প্রকৃতপক্ষে 'কর্ম'কে ফাঁকি দেওয়ার কারো পক্ষে অসম্ভব। কর্ম বিপাক প্রদানের অপেক্ষা করে তাই কেউ কেউ মনে করে কর্মফল দেয় না। একমাত্র উপায় হল কর্মকে ক্ষয় না করে প্রজ্ঞার দ্বারা অবিদ্যা তৃষ্ণা ক্লেশকে সমূলে তুলে ফেলা।
বোধিসত্ত্বের উদানঃ
শিশু বোধিসত্ত্ব ০৭ প্রতি পদক্ষেপে বলেছিলেন-
জগতে আমি অগ্র, জ্যেষ্ঠ, শ্রেষ্ঠ। ইহা আমার অন্তিম জন্ম। আমার আর পুনজন্ম হবে না। ধর্মচক্র প্রবর্তন সুত্রেও বর্ণনা আছে। অবিদ্যা তৃষ্ণাকে সমূলে উৎপাটন করে হয় পুনজন্ম নিরোধ করা। ইহা অন্তিম জন্ম, আর পুনজন্ম নাই। পুনজন্মকে শেষ করে প্রতিসন্ধির কৃত্য পরিসমাপ্ত হয়েছে। সমস্ত কর্ম কৃতকরণীয় হয়েছে।
বর্ত বা চক্রাকার বিচরণঃ- ক্লেশ বর্ত- আশা করে। কর্মবর্ত - কাজ করে। বিপাকনং - পায়। পেলে আরো আশা করে। আশা করলে আরো করে নেয়।
করলে আরো উৎপন্ন হয়। ইহাই সংসার বর্ত।
ক্লেশবর্ত, কর্মবর্ত দুইটি পুরাপুরি থেমে গেলেও বিপাক রয়ে যায়। বিপাকের আয়ু ফুরিয়ে গেলে নতুন বিপাকবর্ত উপস্থিত না হলে বর্ত নিরোধ হয়।
সবার জন্ম মৃত্যুর রহস্যের জ্ঞান ভাণ্ডার পূর্ণ হোক।
লেখক-
স্বধর্ম দেশক, বিদর্শন আচার্য
ভদন্ত পঞ্ঞাদীপ থের
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।
তারিখ-২৪ জুলাই ২০২১ খ্রিঃ।
Comments
Post a Comment